বাংলাদেশের উপকূলবর্তী প্রায় ৭৩ লক্ষ মানুষের জীবিকা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সামুদ্রিক মৎস আহরনের সাথে জড়িত। ২০১৫ সালে সমুদ্র থেকে আহরিত মাছের পরিমাণ ছিল প্রায় ৬ লক্ষ টন। সমুদ্র থেকে যে মাছ ধরা পড়ে তার প্রায় শতকরা ২০ ভাগ মাছ শুঁটকি হিসেবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়
প্রাচিনকাল থেকেই বাংলাদেশের শুটকি মাছের প্রচলন রয়েছে। মূলত মাছ সংরক্ষণ করার প্রয়োজন থেকেই শুঁটকি করা হয়। একসময় দেশের সব অঞ্চলে সামুদ্রিক শুটকি মাছ সহজলভ্য না থাকলেও বর্তমানে সামুদ্রিক মাছের শুটকির বাজারজাতকরণ বেড়েছে। প্রায় সব জায়গাতেই এটি এখন পাওয়া যায়।
সমুদ্র থেকে আহরিত মাছের মধ্যে ৮ থেকে ১০ প্রজাতির মাছ শুঁটকি হিসেবে জনপ্রিয়। এগুলো হচ্ছে লইট্রা, ফাইশা, লাক্ষা, ছুরি, রূপচাঁদা, পাতা, ফত্রা, কৈভোলা, মলা, উড়ুক্কু ইত্যাদি। সাধারণত শীতকালে বৃষ্টিপাত কম থাকে বলে এই সময়ে শুটকি উৎপাদন বেশি হয়। বাংলাদেশের কক্সবাজারে সবচেয়ে বেশি শুঁটকি উৎপাদিত হয়। তবে চট্রগ্রাম এবং বৃহত্তর বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলে প্রচুর শুটকি উৎপাদিত হয়।
প্রচলিত পদ্ধতিতে উৎপাদিত শুটকি
মাছ রোদে শুকিয়ে শুঁটকি করা হয়। শুটকি করার যে প্রচলিত পদ্ধতি রয়েছে তা মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। প্রথমত, শুটকি করার আগে মাছ প্রজাতি অনুযায়ী বাছাই করা হয় না। একসাথে বেশি শুটকি করার সময় নাড়িভুড়ি ও কাদামাটি পরিস্কার করা সম্ভব হয় না। মাছ পচে যাবার সম্ভাবনা দেখা দিলে শুটকি শুরু করার আগে তাতে লবণ মেশানো হয়।
এক্ষেত্রে খরচ বাচাতে অপরিশোধিত মাটি মেশানো লবণই প্রয়োগ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় মাছ মাটিতে বা চাটাইয়ে শুঁকানো হয়। যেখানে কাক, কুকুর, মাছি ও অন্যান্য পোকা মাকড় অবাধে মুখ দেয় এবং অন্য ময়লা এনে ফেলে।
সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হচ্ছে, শুঁকানোর প্রক্রিয়ায় প্রায়ই মাছে পচন ধরে এবং সেই পচন রোধ করতে ডিডিটি, নানা ধরনের কীটনাশক ও অন্যান্য বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য মাছের উপর প্রয়োগ করা হয়। যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
বিষমুক্ত শুটকি উৎপাদন
খাদ্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের শরীরে পুষ্টি চাহিদা মেটানো। কিন্ত প্রায়ই আমরা পুষ্টির বদলে নিজেদের অজান্তেই নানা বিষাক্ত দ্রব্য গ্রহণ করি যা স্বাস্থ্যহানী ঘটায়। কোস্ট ট্রাস্ট কক্সবাজারের শুটকি উৎপাদন অঞ্চলে পিকেএসএফ এর আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় বিষমুক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত শুটিকি উৎপাদনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে আসছে। তার ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসম্মত শুটকি উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে স্থানীয় উৎপাদকদের সহায়তাও করে আসছে।
“বিষমুক্ত শুটকি উৎপাদনে ফিস ড্রায়ার ও জৈব প্রযুক্তি সম্প্রসারণ” শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় কোস্ট ট্রাস্ট আধুনিক প্রযুক্তির ফিস ড্রায়ার এবং মাছের শুটকির প্রক্রিয়াজাতকরণে জৈব প্রযুক্তি ব্যবহার করতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে উদ্বুদ্ধ করছে। যার ফলে বিষমুক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত শুটকি ক্রমেই জন্যপ্রিয় হচ্ছে।
ফিশ ড্রায়ার
শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরনে একটি আধুনিক পদ্ধতি হচ্ছে ফিস ড্রায়ার। এটি হচ্ছে স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে চারদিকে ঘেরা দেয়া এক্তি বড় আয়তাকার বাক্স বা ঘর বিশেষ, যার মধ্যে শুঁটকি শুঁকানো হয়। স্বচ্ছ পলিথিনের মধ্য দিয়ে সহজেই সূর্যকিরণ এই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে। কিন্ত গরম হয়ে যাওয়া বাতাস পলিথিনের দেয়াল থাকায় আর বায়ুমন্ডলে ফেরত যেতে পারে না। ফলে, ড্রায়ারের ভেতরের পরিবেশ খুব গরম হয়ে উঠে। পাশাপাশি ড্রায়ারের ভেতরে একটু ফ্যান দিয়ে মাছের উপর দিয়ে বাতাস প্রবাহিত করানো হয়। এতে দ্রুত মাছ শুকিয়ে উঠে।
ঘরটি মাটি থেকে কিছুটা উঁচুতে স্থাপন করা হয়। উপর-নিচ ও চারপাশ পলিথিন দিয়ে নিশ্ছিদ্রভাবে ঘেরা দেওয়া থাকার কারণে এখানে মাছি বা অন্য কোন নোংরা বহনকারী পোকামাকড় বা কাক, চিল, শকুন এসে বসতে পারেনা। ফলে কোন ধরনের অস্বাস্থ্যকর পদার্থ দ্বারা মাছ সংক্রমিত হতে পারেনা। একারণে এতে কোনো প্রকার বাড়তি কীটনাশক জাতীয় কোন রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগ করার প্রয়োজনই পড়েনা।
জৈব প্রযুক্তি
মাছ শুঁটকি করার জৈব প্রযুক্তি হচ্ছে কোন ধরনের কৃত্রিম রাসায়নিক পদার্থ ছাড়াই খাদ্যযোগ্য নানা জৈব পদার্থ ব্যবহার করে শুটকি প্রক্রিয়াজাত করা। জৈব প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে শুটকির রঙ ও স্বাদ যেমন অক্ষুন্ন থাকে, তেমনি ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য না থাকার কারণে এতে পুষ্টিমান শতভাগ অপরিবর্তিত থাকে। জৈব প্রক্রিয়ায় শুঁটকি উৎপাদনের ধাপগুলো হচ্ছেঃ
ধাপ ১ঃ মাছ সংগ্রহ
ক. শুঁটকি করার জন্য উপযোগী টাটকা মাছ সংগ্রহ করা
খ. পরিষ্কার পানি দ্বারা মাছ থেকে কাদামাটি ও অন্যান্য বাহ্যিক ময়লা ধুয়ে চকচকে করে ফেলা
গ. মাছের গাদায় পচা গলা মাছ থাকলে সেগুলো বেছে ফেলে দেয়া
ধাপ ২ঃ বাছাই
ক. ক্রেতার চাহিদা অনুসারে মাছের প্রজাতি ভেদে বাছাই করা।
খ. একই প্রজাতির মধ্যে আবার আকার ও জৈবিক অবস্থা (ডিম/চর্বি) অনুসারে সেগুলো আলাদা করা। ডিমওয়ালা ও বেশি চর্বিযুক্ত মাছ শুঁটকি করার উপযুক্ত নয়
ধাপ ৩ঃ ড্রেসিং
ক. মাছ ধোয়ার জায়গা প্রস্তত করা
খ. নাড়ি ভুড়ি বের করা, আশ ফেলা এবং প্রয়োজনে স্লাইস করে আংশিক কেটে ড্রেসিং করে নেওয়া। যেমন- ছুরি মাছের পেটে অন্য মাছ থাকলে তা অবশ্যই নাড়ি ভুড়ির সাথে বের করে নিতে হবে। রুপচাদা মাছের নাড়ি-ভুড়ি বের করার প্রয়োজন নেই, তবে বড় মাছ স্লাইস করে কেটে নিলে ভালো শুঁটকি হয়।
ধাপ ৪ঃ পানি ঝরানো
ড্রেসিং করা মাছের বাশের আড়ায় সারিবদ্ধভাবে ঝুলিয়ে পানি ঝরিয়ে নিতে হবে। পানি না ঝরিয়ে গাদা করে রাখলে মাছ নষ্ট হয়।
ধাপ ৫ঃ জৈব উপাদান প্রয়োগ
পানি ঝরার পর হলুদ ও মরিচের গুড়ার মিশ্রণ দিয়ে প্রস্তুত করার পানিতে ভালো করে চুবিয়ে তুলে মাছ শুকাতে দিতে হবে। প্রতি ১০ লিটার পানিতে অন্তত ২৫০ গ্রাম হলুদ ও সমপরিমান মরিচের গুড়া মিশিয়ে মাছ ডুবানোর জন্য একটা ড্রামে রাখতে হবে। শুটকির জন্য প্রস্তুত করা মাছ এতে অন্তত ৩ মিনিট ভিজিয়ে রাখতে হবে।
ধাপ ৬ঃ নিরাপদ জায়গায় শুকানো
হলুদ মরিচে ভেজানো মাছ সারিবদ্ধ ভাবে পর্যাপ্ত রোদ পায় এমন জায়গায় শুকাতে দিতে হবে। প্রাথমিকভাবে মশারির জাল দিয়ে মাছ ঢেকে দিতে হবে। মশারি দিয়ে তৈরি মাচার মধ্যে মাছ শুকানো আরো ভালো। এতে করে মাছ কাক, চিল, শকুন ইত্যাদির ক্ষতিকর ও নোংরা পাখি থেকে নিরাপদ থাকে। প্রাথমিকভাবে রোদে শুকানোর পর ফিস ড্রায়ারে দিয়ে শুকানো যেতে পারে।
কাচা মাছ শুকিয়ে তার ওজন এক চতুর্থাংশ হলে অর্থাৎ ৪ কেজি মাছ শুকিয়ে ১ কেজি শুঁটকি হলে তা প্যাকেট করার উপযুক্ত হয়।
ফিস ড্রায়ার ও জৈব প্রযুক্তি ব্যবহারের উপকারিতা ও বৈশিষ্ট্য
- জৈব প্রযুক্তির শুঁটকি দেখতে উজ্জ্বল এবং স্বাদে কোন কৃত্রিমতা নাই.
- পুষ্টিমান শতভাগ অক্ষুণ্ন থাকে। প্রচলিত পদ্ধতিতে উৎপাদিত শুটকিতে সর্বোচ্চ ৫৫% আমিষ পাওয়া যায়, যেখানে ফিস ড্রায়ার ও জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত শুটকিতে ৬৫% পর্যন্ত আমিষ পাওয়া যায়।
- প্রচলিত পদ্ধতিতে শুটকিতে ২৫% এর উপরে জলীয় পরিমাণ পাওয়া যায়। ফিস ড্রায়ার দিয়ে শুকানো মাছে সর্বোচ্চ ১২% জলীয় অংশ থাকে।
- জৈব প্রযুক্তিতে উৎপাদিত শুটকিতে বিভিন্ন খনিজ লবণের পরিমাণ প্রায় ১৭% যেখানে প্রচলিত পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ ১০% পাওয়া যায়।
- ফিস ড্রায়ার ও জৈব প্রযুক্তি ব্যবহার করে শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণ আপাত দৃষ্টিতে কিছু ব্যয়বহুল হলেও প্রচলিত পদ্ধতিতে শুঁটকি তৈরি করতে ৫-৬ দিন লেগে যায়। কিন্ত এক্ষেত্রে ৩ দিনেই শুঁটকি উৎপাদিত হয়। লাক্ষা, রুপচাদা ইত্যাদি উচ্চমূল্যের মাছ শুঁটকি করতে এই পদ্ধতি বেশি সাশ্রয়ী। কারণ এক্ষেত্রে মাছের ক্ষতি প্রায় হয়না বললেই চলে।
- সর্বোপরি, এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত মাছে কোন ধরনের কৃত্রিম ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার করা হয় না। সম্পুর্ন প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে শুঁটকি উতপাদন করা হয়।
তথ্য সূত্রঃ কোস্ট ট্রাস্ট